মো.সাইফুল ইসলাম রণি: নদী বিধৌত অপূর্ব সুন্দর এক জেলা চাঁদপুর। পদ্মা-মেঘনা ও ডাকাতিয়া এ জেলার ব্যাবসার-বাণিজ্য তথা ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য জেলার সাথে যোগাযোগ মাধ্যমকে সহজ করে দেয়ার পাশাপাশি চাঁদপুরকে দিয়েছে এক নৈসর্গিক সুন্দর রুপ। তবে প্রতিটা সুন্দরের আড়ালে কোনো না কোনো কষ্ট বা ত্যাগ লুকিয়ে থাকার মতোই সুন্দরের নিদর্শন এই ত্রিনদী কারো কারো জন্য অভিশাপ হয়ে দেখা দিচ্ছে।
চাঁদপুর সদরউপজেলা, মতলব উত্তর ও হাইমচর উপজেলার পশ্চিমে রয়েছে পদ্মা ও মেঘনা নামক দু’টো নদী। আর এ দু’টো নদীর বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে মেঘনার পশ্চিম পাড়ে জেগে রয়েছে ছোট-বড় প্রায় ৪০ টি চরাঞ্চল। এসব চরাঞ্চলে দেড় থেকে দুই লাখ লোকের বসবাস। প্রায় প্রতিটি চরেই স্কুল, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন হাটবাজার গড়ে উঠেছে।
এসব চরাঞ্চলের ৯০ ভাগ মানুষ নদীতে মাঝ ধরা ও কৃষি কাজের উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। জেলার ৩ উপজেলার নদী সিকিস্তি এসব চর এলাকার মানুষের দৈনন্দিন কাজ বা চিকিৎসার জন্য ছুটতে হয় শহরের উদ্দেশ্যে।
এছাড়াও পশ্চিম অবস্থিত প্রতিবেশী শরিয়ত জেলার বেশকিছু চরাঞ্চল পদ্ম-মেঘনার তীরবর্তী হওয়ায় ওই সকল এলাকা থেকেও বিভিন্ন প্রয়োজনে প্রতিদিন সহ¯্রাধিক মানুষ চাঁদপুর শহরে আসা-যাওয়া করে। নদী সিকিস্তি এরসকল চরাঞ্চলের মানুষগুলোর জেলা সদরে যোগাযোগের একমাত্র বাহন হচ্ছে ইঞ্জিন চালিত নৌকা (ট্রলার)। বহুকাল ধরে ওই এলাকার সাথে জেলা সদরের উন্নত যাতায়াত ব্যাবস্থা না থাকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়েই অনেকটা নিরুপায় এসকল শিশু ও নারী-পুরুষ সহ সবাই ট্রলারে নিয়মিত আসা যাওয়া করেছে।
খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, চাঁদপুর শহরের পুরাণবাজার ট্রলার ঘাট, ভূইয়ার ঘাট, মতলব, হরিণা ও হাইমচর থেকে প্রতিদিন প্রায় অর্ধশত ইঞ্জিনচালিত ছোট-বড় ট্রলার রাজরাজেশ্বর, চরকাশি, চরওমেদ, চরফ্যাশন, বোরচর, ইশানবালা, ৬ষ্ঠ খ- বোরচর, আলুর বাজার, আলগী, সুরেশ্বর, চেয়ারম্যানঘাট সহ বিভিন্ন চরাঞ্চলের চলাচল করছে। এসব ট্রলারে ১০০/ ১৫০ জন পর্যন্ত নারী-পুরুষ ও শিশু যাত্রী জীবনের ঝুঁকি নিয়েপদ্মা-মেঘনার ১০/১৫ মাইল পূর্ব-পশ্চিম নদী পাড়ি দিচ্ছে।
এছাড়াও ট্রলারগুলোতে একই সাথে যাত্রীদের ঠাসাঠাসি করে উঠানো পাশাপাশি ওই এলাকার হাটবাজারের ব্যাবসায়ীদের বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী উঠানো হচ্ছে। যার ফলে সামান্য ঝড়, প্রভল স্রোত অথবা উত্তাল ঢেউয়ে প্রয়ই ট্রলারগুলো ভারসাম্যহীন হয়ে নদীতে ডুবে যাচ্ছে। এতে প্রাণহানীর ঘটনাও ঘটছে অহরহ।
চরাঞ্চলের নিত্যদিন পারাপার হওয়া ষাটোর্ধ্ব যাত্রী হালিম শেখের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ‘গত ১০ বছরে পদ্মায়-মেঘনায় ছোট-বড় প্রায় ১৫/২০টি নৌকা ও ট্রলার ডুবে গেছে। এতে ২০/৩০ জনেরমতো প্রাণহানি ঘটনা ঘটেছে। এছাড়াও লক্ষ-লক্ষ টাকার মালামাল নদীর তলদেশে হারিয়ে গেছে।’
সদর উপজেলার ১৪ নং রাজরাজেশ্বর ইউনিয়নের বাসিন্দা রহমান ছৈয়াল এশিয়ানবার্তা কে জানান, ‘প্রতিদিন চরাঞ্চল থেকে কাঁচা তরকারি, মাছ ও প্রচুর পরিমাণে দুধ শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই জীবীকার প্রয়োজনে তাদের এই নদীপথ পাড়ি দিতে হচ্ছে।’
তিনি জানান, চরাঞ্চলের এসকল মানুষগুলো গর্ভবতী মা’ সহ অসুস্থ্য রুগীদের হাসপাতালে নেওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হয়। তাছাড়া বিকেলের পর থেকে যাত্রি পাড়াপাড়ের কোনো নৌ-যান না থাকায় অনেক সময় তারা অসহায় বনে যান। তাদের দাবি সরকারি ব্যবস্থায় এ নদী পথে যদি উন্নত নৌ-যানের ব্যবস্থা করা হয় তবে এই মানুষগুলো উপকৃত হতো।
চাঁদপুর সদর উপজেলার ১৪নং রাজরাজেশ্বর ইউনিয়ন পরিষদ (মেঘনার পশ্চিম পাড়) চেয়ারম্যান হযরত আলী বেপারী এশিয়ান বার্তা কে বলেন, ‘বর্ষাকাল ছাড়াও সব মৌসুমেই চরাঞ্চলের মানুষ ট্রলারে যাতায়াত করে থাকে। ঝুঁকিপূর্ণ হলেও কিছু করার নেই। কারণ অন্য কোনো মাধ্যম নেই। জেলা সদরের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রাখতে হয়। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া দেখা দিলেও অনেক সময় যাত্রী ও মলামালসহ ট্রলারগুলো ডুবে যায়।
আমরা প্রশাসনের কাছে বারবারই দাবি করেছি চরাঞ্চলের মানুষের নিরাপদ যাতায়েত ব্যবস্থার জন্য উন্নত নৌযানে ব্যবস্থা করার জন্য।’ চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, জেলার মেঘনা নদীর সীমানা ৩৬০ দশমিক ১১ কিলোমিটার। এরমধ্যে পদ্মা-মেঘনা ও ডাকাতিয়া এ তিন নদীর সংযোগস্থল মেঘনা-মোহনা।
এ নদীগুলো তিন দিক থেকে প্রবাহিত হয়ে মিশে যাওয়ায় এখানে সর্বক্ষণ পানির এক বিশাল ঘূর্ণিগর্তের সৃষ্টি হয়। এই ঘূর্ণিগর্ত এলাকাটি জাহাজ চলাচলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। সরকারিভাবেও চাঁদপুরকে সবচেয়ে ঝূঁকিপূর্ণ নৌপথ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
Leave a Reply