সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি : সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলায় টাকা চুরির মিথ্যা অভিযোগে ১২বছরের শিশু রফিকুল ইসলাম আপেলকে ধরনার সাথে ঝুলিয়ে প্রায় ১০ঘন্টাব্যাপী মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করেছে প্রভাবশালীরা। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য মঙ্গলবার দুপুরে সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
শিশু আপেল ওই উপজেলার সগুনা ইউনিয়নের কুন্দুইল পূর্বপাড়ার দরিদ্র কৃষক জায়েদুল ইসলামের ছেলে। অভিযোগে প্রকাশ, উক্ত উপজেলার কুন্দইল পূবৃপাড়া গ্রামের প্রভাবশালী মমিনের দেড় লাখ টাকা চুরির মিথ্যা অপবাদে গত বৃহস্পতিবার সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এ নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। ওই দিন সন্ধ্যায় পুলিশ তাকে ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে তাড়াশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে।
তিন দিন চিকিৎসার পর তার অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় মঙ্গলবার দুপুরে সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। মঙ্গলবার বিকেলে সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতালের অর্থপেডিক বিভাগে গিয়ে কথা হয় নির্যাতিত শিশু আপেলের সাথে। এ প্রতিবেদকের কাছে আপেল বর্ণনা করতে থাকে ভয়াল সেই নির্যাতনের কথা। এ সময় ভয় আর আতংক তাকে ঘিরে ধরে। বার বার এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে কেউ তার কথা শুনছে কিনা। এসময় এ প্রতিবেদক অভয় দিলে সে জানায়, ২৬ অক্টোবর বৃহস্পতিবার সকাল ৭টার দিকে সে তার বাড়ির পাশে বসে ছিলো।
এমন সময় উল্লেখিত গ্রামের মৃত মকবুল সরকারের ছেলে আব্দুল হান্নান তাকে ডেকে নিয়ে প্রতিবেশি মৃত মকবুল সরকারের ছেলে আব্দুল মমিনের বাড়িতে নিয়ে যান। এ সময় ওই বাড়িতে একই গ্রামের বাকের খার ছেলে মঞ্জিল, মজিদ, তৈজুদ্দিন, মৃত আলতাফ কেরানীর ছেলে রসুল, মৃত ময়দান সরকারের ছেলে মঈনুল, অলি, মৃত চুনুর ছেলে মোজদার, মৃত মহসীন সরকারের ছেলে মোয়াজ্জেম হোসেনসহ সবাই আব্দুল মমিনের বাড়ি থেকে গত বুধবার রাতে চুরি হওয়া দেড় লাখ টাকা শিশু আপেল চুরি করেছে বলে অভিযোগ করে তা ফেরত দিতে বলে।
একথা শুনে শিশু আপেল টাকা নেয়নি বলে জানালে শুরু হয় তার উপর অমানষিক নির্যাতন। শিশু আপেলের ভাষ্যমতে প্রথমে মঞ্জিল তাকে প্রথমে লাঠি দিয়ে হাতে পায়ে পিটাতে শুরু করে। উপস্থিত উল্লেখিত ব্যক্তিরা একে একে এলোপাথারি মারপিট শুরু করে। এ সময় আপেল অনেক কাকুতি-মিনতি করে তাদের বুঝাতে চায় চুরি যাওয়া টাকা সে নেয়নি। কিন্তু শত কাকুতি মিনতি করেও পাষন্ডদের মন গলাতে পারেনি। পরে দু’হাত ঘরের ধরণার সাথে উঁচু করে বেঁধে তার উপর চালাতে শুরু করে নির্যাতন। চুরির স্বীকারোক্তি না পেয়ে তাদের অত্যাচারের মাত্রা আরো বেড়ে যায়।
লেপ-তোষক সেলাই করা সুঁচ দিয়ে তার হাতে-পায়ের আঙ্গুলে ঢুকিয়ে চুরির স্বীকারোক্তি নেওয়ার চেষ্টা করে। এতেও কোন ফল না পেয়ে নির্যাতনের ধরন আবারো পাল্টে সাড়া শরীরে বৈদ্যুতিক শক দিতে শুরু করে। তাদের এমন পৈশাচিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে এক পর্যায়ে চুরি করেছে বলে শিশু আপেল স্বীকার করে। তখন নির্যাতনকারীরা টাকা বেড় করতে আপেলকে নিয়ে তার বাড়িসহ বিভিন্নস্থানে তল্লাশি চালিয়ে টাকা না পেয়ে আবারও শুরু করে পৈশাচিক নির্যাতন। এসময় নির্যাতনকারীরা তার নাকের ভিতর গরম পানি ঢালতে থাকে।
সে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেও তাদের নির্যাতনের মাত্রা একটুও কমেনি। এসব বর্ণনা করতে গিয়ে শিশু আপেল ভয়ে বার বার আঁৎকে ওঠে। তাকে সান্তনা ও অভয় দিলে আবারো শুরু করে বাকী নির্যাতনের বর্ণনা। আপেল বলে, কোন ভাবেই টাকা না পেয়ে নির্যাতনের ধরণ আবারো পাল্টে দেয়া হয়। শুরু হয় সাড়া শরীরে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে স্বীকারোক্তি ও চুরি যাওয়া টাকা উদ্ধারের চেষ্টা। এক পর্যায়ে বৈদ্যুতিক কাজে ব্যবহৃত প্লাস দিয়ে বাম কানের খানিক অংশ ছিড়ে ফেলা হয়।
এ সময় আপেলের আত্মচিৎকারে প্রতিবেশিরা ওই নির্যাতনকারীদের কাছ থেকে শিশুটিকে বাঁচানোর জন্য আকুতি জানালেও কোন কাজ হয়নি। যেই শিশুটিকে ছেড়ে দিতে বলে ওই নির্যাতনকারীরা তার কাছেই চুরি যাওয়া দেড় লাখ টাকা দাবী করে। এ ব্যাপারে কথা হয় নির্যাতিত শিশু আপেলের বাবা জায়েদুল ইসলামের সাথে। তিনি বলেন, নির্যাতনকারীরা এলাকায় অত্যন্ত প্রভাবশালী। তারা অন্যায় কিছু করলেও কেউ তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পায় না। আমার ছেলে আপেলকে তারা বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে মিথ্যা চুরির অপবাদ দিয়ে অমানষিক নির্যাতন করেছে।
আমার ছেলেকে মুমূর্ষ অবস্থায় পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে তাড়াশ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে। সেখানে ছেলে অবস্থার উন্নতি না হলে মঙ্গলবার দুপুরে সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতালে স্থানান্তর করে। এবিষয়ে থানার ওসি সাহেবের কাছে আমার ছেলেকে নির্যাতনের বিষয়ে অভিযোগ করলেও তিনি এখনো অভিযোগটি এজাহার হিসেবে রেকর্ড করেননি। এ ব্যাপারে তাড়াশ থানার ওসি এটিএম আমিনুল ইসলাম শিশু আপেলের নির্যাতনের ঘটনা স্বীকার করে বলেন, উভয় পক্ষ থানায় অেিভযোগ করেছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
Leave a Reply