গাইবান্ধা থেকে ফারুক হোসেন: গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে দশ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রি শুরু হয়নি। ফলে ওইসব ইউনিয়নের দরিদ্র মানুষ কমদামে চাল ক্রয়ের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এমনকি সেপ্টেম্বর মাস থেকে কার্যক্রম শুরু হলেও প্রথম মাসেই তারা কমদামে চাল কিনতে পারলেন না। তালিকা প্রণয়ন নিয়ে ডেপুটি স্পীকার ও ইউপি চেয়ারম্যানদের দ্বন্দ্বের কারণে এ জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে।
জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয় সুত্র জানায়, বছরের পাঁচমাস (মার্চ, এপ্রিল, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর) গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের হাতে কোন কাজ থাকে না। এই মাসগুলোতে দরিদ্রদের সহায়তার জন্য সরকার খাদ্যবান্ধব কর্মসুচি (সরকার নির্ধারিত দামে কার্ডের মাধ্যমে চাল ও গম বিতরণ কর্মসুচি) হাতে নিয়েছে। কর্মসুচির আওতায় গাইবান্ধায় সাতটি উপজেলায় ১ লাখ ১৭ হাজার ২৩৭ জন দরিদ্র মানুষের মধ্যে দশ টাকা কেজিতে চাল বিক্রি করার কথা। জেলায় ১৫৬ জন ডিলারের মাধ্যমে এই চাল বিক্রি হবে।
কর্মসুচির নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতিজন সুবিধাভোগী একমাসে ত্রিশ কেজি চাল কিনতে পারবেন। একটি কার্ডের মাধ্যমে একজন সুবিধাভোগী বছরের পাঁচমাস এই দামে চাল কিনতে পারবেন। সুবিধাভোগিদের তালিকা প্রণয়নে একজন উপজেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাকে সভাপতি করে প্রতিটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়ে কমিটি থাকবে। এই কমিটি ইউনিয়নে দরিদ্র মানুষের তালিকা তৈরি করে উপজেলা কমিটিতে পাঠাবেন। উপজেলা কমিটি অনুমোদনের পর সুবিধাভোগীদের মধ্যে কার্ড বিতরণ করা হবে।
এই কার্ড দেখিয়ে সুবিধাভোগীরা ইউনিয়নের নির্ধারিত ডিলারের কাছ থেকে প্রতিকেজি চাল দশ টাকায় কিনতে পারবেন। ইতোমধ্যে জেলার সাতটি উপজেলার মধ্যে ছয়টিতে চাল বিক্রি শুরু হয়েছে। কিন্তু সাঘাটা উপজেলার মোট দশটি ইউনিয়নের মধ্যে নয়টিতে গতকাল সোমবার পর্যন্ত চাল বিক্রি শুরু হয়নি। তালিকা প্রণয়ন নিয়ে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পীকার ও গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনের সাংসদ ফজলে রাব্বী মিয়া এবং ইউপি চেয়ারম্যানদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে চাল বিক্রি বন্ধ রয়েছে।
উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়ন ঘুুরে দেখা গেছে, গ্রামাঞ্চলে এখন দিনমজুরদের হাতে কাজ নেই। তারা হাত গুটিয়ে বসে আছেন। দশ টাকা কেজির চাল পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে উপজেলার বোনারপাড়া ইউনিয়নের ময়মন্তপুর গ্রামের দিনমজুর সাইদুর রহমান (৪৮) ও আমিরুল ইসলাম (৫৫) নিজের ভাষায় বললেন, খালি শুনি ১০ ট্যাকাত একসের চাউল পাওয়া যায়। কিন্তু হামরা চাউল পানো না। চেরমেনের কাচে গেলে কয় কয়দিন পরে দেমো।
জানতে চাইলে বোনারপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুল ওয়ারেছ প্রধান মুঠোফোনে বলেন, লোকসংখ্যা অনুযায়ী এই ইউনিয়নে এক হাজার ৬২৬ টি কার্ড বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু ডেপুটি স্পীকার এই ইউনিয়নে ৫০০ জন সুবিধাভোগির নামের তালিকা সম্বলিত একটি চিঠি দায়িত্বপ্রাপ্ত উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তাকে দিয়েছেন। তাই আমাদের তালিকা জমা নেওয়া হচ্ছে না। ফলে তালিকা চুড়ান্ত করা না যাওয়ায় চাল বিক্রিও শুরু করা যাচ্ছে না।
একই অভিযোগ এনে জুমারবাড়ি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রোস্তম আলী আকন্দ বলেন, ডেপুটি স্পীকার আমার ইউনিয়নে মোট বরাদ্দের শতকরা ত্রিশ ভাগ নামের তালিকা দায়িত্বপ্রাপ্ত উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে দেওয়ায় জটিলতায় পড়েছি। এই জটিলতার কারণে চুড়ান্ত তালিকা তৈরি করতে পারছিনা। ফলে সেপ্টেম্বর মাসে চাল ক্রয়ের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে দরিদ্ররা।
একই উপজেলার কচুয়া ইউনিয়নের বুরুঙ্গি গ্রামের দিনমজুর আনারুল হক (৪০) ও বাদশা মিয়া (৪৫) বললেন, এখন গাঁয়োত কাম নাই। সুদের উপর ট্যাকা নিয়া খাবার নাগচি। একসের চাউল দশ ট্যাকাত পালে ভালো হলো হয়। কিন্তু তাক কোনটে পামো। সগল্যে খালি নাম নেকি নেয় চাউল দেয়না। পদুমশহর ইউনিয়নের পশ্চিম ভরট গ্রামের আব্দুল আজিজ (৪০) বলেন, একন বাজারোত একসের চাউলের দাম ৩৫-৪০ ট্যাকা। সেই চাউল দশ ট্যাকাত প্যালে উপকার হলো হয়। কিন্তু চেরমেন মেম্বারের কাচে গেলে তামরা কয়, ভেজাল বাচ্চে, পরে দেমো।
এ প্রসঙ্গে পদুমশহর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তৌহিদুজ্জামান বলেন, ডেপুটি স্পীকার যে তালিকা দিয়েছেন তার মধ্যে অধিকাংশ পরিবারই স্বচ্ছল। এই তালিকা অনুযাযী চাল বিক্রি করলে প্রকৃত দরিদ্ররা বঞ্চিত হবে। এ কারণে সুবিধাভোগিদের তালিকা চুড়ান্ত করা যাচ্ছে না।
কামালেরপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাজু মিয়া বললেন, ডেপুটি স্পীকার ক্ষমতার প্রভাবে এই তালিকা দিয়েছেন। তার তালিকা মেনে না নেওয়ায় উপজেলার নয়টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা চাল বিক্রি কার্যক্রম শুরু করতে পারছেন না। একই ধরনের অভিযোগ করেন অপর পাঁচটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা।
এসব বিষয়ে সাঘাটা উপজেলা তালিকা প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব এবং উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা স্বপন কুমার দে গতকাল বিকেলে মুঠোফোনে বলেন, ইউনিয়ন থেকে চুড়ান্ত তালিকা না পাওয়ায় নয়টি ইউনিয়নে চাল বিক্রি শুরু করা যাচ্ছে না। তবে ওই নয়টি ইউনিয়নে সেপ্টেম্বর মাসের চাল ছাড় দেওয়া হয়নি।
এসব বিষয়ে জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পীকার এবং গাইবান্ধা-৫ (সাঘাটা-ফুলছড়ি) আসনের সাংসদ ফজলে রাব্বী মিয়া গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোর গাইবান্ধা প্রতিনিধি শাহাবুল শাহীন তোতার মুঠোফোনে বলেন, আমি চার থেকে পাঁচমাস আগে সুবিধাভোগিদের তালিকা দেই।
কিন্তু ইউপি চেয়ারম্যান মেম্বাররা নির্বাচিত হয়ে এই তালিকা মানতে চাননি। পরে উপজেলা পরিষদের সভায় মোট বরাদ্দের শতকরা ৩০ ভাগ দলের জন্য, ১০ ভাগ উপজেলা পরিষদ এবং অবশিষ্টগুলো ইউনিয়ন পরিষদকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এসব কারণে শুধু ভরতখালি ইউনিয়নে চাল বিক্রি হয়েছে। অন্যগুলোতে হয়নি। তিনি আরও বলেন, দ্রুত চাল বিক্রি শুরু করতে সংশ্লিষ্টদের বলেছি।
Leave a Reply