উত্তরাঞ্চলের ভারত সীমান্ত ঘেঁষা ছোট একটি জেলা জয়পুরহাট। জেলা শহরের কেন্দ্রস্থল শহীদ ডা. আবুল কাশেম ময়দানে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের বছরের সাথে মিল রেখে ৭১ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মাণ করা হয় ১৯৯১ সালে। তৎকালীন জেলা প্রশাসকের প্রচেষ্টায় এবং স্থানীয় কিছু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সহযোগিতায় এই স্মৃতিস্তম্ভটি নির্মান করা হয়। আধুনিক স্থাপত্য শিল্পের অপরূপ নির্দশন এই স্মৃতিস্তম্ভটি মুক্তিযুদ্ধ তথা জয়পুরহাটবাসীর জন্য এক গৌরবগাথা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
জেলার পাঁচবিবি উপজেলায় ১৯৭১ সালের ২০ এপ্রিল মঙ্গলবার পাকিস্তানি সৈন্যরা পাঁচবিবি থানা দখল করে নেয়। সেখানে তারা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হতাহত করে অনেক নিরীহ মানুষকে। পুরাতন সিও অফিস, বকুলতলা, নন্দাইল ও বাগজানাসহ বিভিন্ন এলাকায় ২৪ এপ্রিল থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত চালায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। তাদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পাঁচবিবি পাঁচমাথায় নির্মাণ করা হয়েছে উত্তরবঙ্গের বৃহৎ মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ‘মিলেছি মায়ের ডাকে’। এ ভাস্কর্যে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের চারজন বীর মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। ভাস্কর্যটির মাধ্যমে মহান মুক্তিযুদ্ধে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের যে অংশগ্রহণ ছিল, তা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় ১৯৭১ সালের ২৬ আগষ্ট সোমবার বিকালে তৎকালীন কড়িয়া বিডিআর ক্যাম্পের পাক সেনারা ধরঞ্জী ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে মহড়া দিয়ে যাওয়ার সময় নন্দইল গ্রামের লক্ষণ হেমরমের দুই পুত্র খোকা হেমরম ও মন্টু হেমরম, একই গ্রামের কালু সরেনের পুত্র জোহন সরেন ও সরেন হেমরমকে বাড়ী থেকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যায়। পথিমধ্যে উপজেলার পাড়ইল তিতলতলা নামকস্থানে তাদের হাত পা বেঁধে মাটির গর্তে ফেলে বন্দুকের ব্যায়নট দিয়ে নির্মম নির্যাতন করে জীবন্ত অবস্থায় মাটি চাপা দিয়ে হত্যা করে। আদিবাসীদের ঐতিহ্য ও সংগ্রামের ইতিহাসের প্রতীক হিসেবে সেই শহীদের স্বরণে শ্রদ্ধা জানিয়ে পাঁচবিবির আদিবাসী এলাকা নন্দাইল গ্রামে তৈরি করা হয়েছে ২১ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট দেশের প্রথম আদিবাসী ভাস্কর্য। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বিশিষ্ট কলামিষ্ট ও সাংবাদিক আমিনুল হক বাবুলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ২০১০ ও ২০১১ অর্থ বছরে জয়পুরহাট জেলা পরিষদের অর্থায়ন ও তত্বাবধানে এটি নির্মিত হয়।
এছাড়া উপজেলা শহরের তিনমাথায় ‘গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা’ ও রেলস্টেশন এলাকায় ‘কৃষক মুক্তিযোদ্ধা’ ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলো নির্মান করেন পাঁচবিবি পৌর মেয়র হাবিবুর রহমান হাবিব।
এছাড়া শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সামনে ২০১৬ সালের ১৪ জানুয়ারি উন্মোচন করা হয় ”প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ ‘৭১” নামের একটি ভাস্কর্য। এটি সে সময়ের পুলিশ সুপারের প্রচেষ্টায় এবং স্থানীয় কিছু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সহযোগিতায় নির্মাণ করা হয়।
এইসব ভাস্কর্য, স্মৃতিস্তম্ভ ও স্মৃতিফলকগুলো আজও মনে করিয়ে দেয় মুক্তিযুদ্ধে উৎসর্গকারী লাখো শহীদের স্মৃতিকথা ও যুদ্ধদিনের ভয়াল স্মৃতি।