এম.দুলাল উদ্দিন আহমেদ: বাঁশি বাজিয়ে অন্যকে আনন্দ দেওয়ার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছেন বাঁশিওয়ালা রহমত আলী। এটাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন তিনি। তবে সৃজনশীল এ পেশায় রহমত আলীর মতো অনেকে জড়িত থাকলেও এ পেশাকে মুল পেশা হিসেবে নিয়েছেন এমন মানুষের সংখ্যা রয়েছে খুবই কম । রহমত আলীর নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। শুধু নিজের আগ্রহ ও প্রচেষ্টায় তিনি বাঁশির সুর নিয়ে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন দেশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত। বিনোদনের মাধ্যমে কেড়ে নিয়েছেন তিনি মানুষের মন। বাঁশির সুরের উপার্জন আর বাঁশি বিক্রির টাকায় চালাচ্ছেন সংসার। একবেলা খেয়েও যাচ্ছে আরেকবেলা না খেয়েও যাচ্ছে তার পরিবারের সদস্যদের। তার পরও বাঁশি আর বাঁশির সুর হৃদয়ে আকড়ে ধরে রেখেছেন বাঁশিওয়ালা রহমত আলী। কিন্তু সংসারের অভাবের সুরে যেন আজ হারিয়ে যাচ্ছে তার বাঁশির সুর!
সিরাজগঞ্জ সদরের নলছিয়াপাড়ায় রহমত আলীর বসবাস। নিজস্ব জায়গা বলতে কিছুই নেই রহমত আলীর। পরের জায়গার উপর একটি ঝুঁঁপড়ি ঘর তুলে সেখানেই পরিবার নিয়ে বাস করছেন তিনি। ওস্তাদ মুকুল বয়াতীর নিকট থেকে শখের বশে ছবক নিয়ে বাঁশির সুর টানলেও বর্তমানে জীবিকা নির্বাহের প্রধান কর্ম হয়ে উঠেছে রহমত আলীর বাঁশির সুর। চিত্ত বিনোদনে দর্শক-শ্রোতাদের মন কেড়ে নিচ্ছে তার এই বাঁশির সুর। বাঁশির সুর তোলার সময় যেন দেহ-মন মগ্ন করে তোলেন তিনি শ্রোতাদের জন্য। তার লক্ষ্য হচ্ছে,দুটি পয়সা উপার্জন করা। এই বাঁশি বাজিয়ে এবং দর্শক স্রোতাদের মন জয় করে যেটুকু সম্মানি পান আর বাঁশি বিক্রি থেকে যা আয় আসে তাই দিয়ে অতিকষ্টে জীবন চলে তার পরিবারের সদস্যদের। এ আয় রোজগারেও আবার ভাটা পড়েছে। এজন্য বিশেষ কোন সময়ে তিনি তার স্ত্রী,দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নতুন কোন জামা কাপড়ও দিতে পারেন না। বাঁশের বাঁশি সর্ম্পকে ধারনা দিতে গিয়ে আবেগাপ্পুত হয়ে নিদারুন এ কষ্টের কথাগুলো বলছিলেন বাঁশিওয়ালা রহমত আলী।
সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ঘুরে বাঁশি বাজান ও বাঁশি বিক্রি করেন রহমত আলী। ঘুরে বেড়ানোর একটি মুহুর্তে এ প্রতিবেদকের সাথে দেখা মেলে রহমত আলীর। এসময় এ প্রতিবেদকের সাথে চায়ের টেবিলে বসে রহমত আলী জানান তার জীবন কাহিনী। দুঃখগাঁথা জীবন কাহিনী বলতে গিয়ে চা খাওয়ার কথা ভুলে যান তিনি। ঠান্ডা চায়ের কাপে ঠোঁট লাগিয়ে তা একবার পান করেই আবার শুরু করেন তার জীবনের কষ্টের ইতিহাস। এসময় তার হাতে,কোঁমড়ে ও কাঁধে ছিল ব্যাগ ভর্তি বাঁশি। কথার মাঝেই তার হাতের বাঁশি ও মন যেন বার বার বাঁশির সুর তুলছিল। প্রতিটি কথার সময় তিনি বাঁশি নিয়েছেন মুখের সামনে এবং কথার দিকে মনোযোগি না হয়ে বারে বারে বাঁশির সুর তুলতে ব্যাকুল হয়ে পড়েছেন। এক পর্যায়ে আলাপ বন্ধ করে বাঁশি বাজান শুরু করেন তিনি। চায়ের দোকানে বাঁশি বাজানোর সময় অনেকেই তার বাঁশির সু-মধুর সুর শোনার জন্য ভিড় করেন। বাঁশি বাজিয়ে আগত দর্শকদেরকে মুগ্ধ করেন বাঁশিওয়ালা রহমত আলী।
সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে রয়েছে বাঁশিওয়ালা রহমত আলীর বেশ কদর। তাকে প্রয়োজন রয়েছে সাংস্কৃতিক কর্মী ও বয়াতীর দলেও। দীর্ঘ ২১টি বছর ধরে রহমত আলী বাঁশের বাঁশি বাজিয়ে এবং বাঁশির সুর তুলে শ্রোতা দর্শকের মনোরঞ্জন করে চলেছেন। তিনি লেখাপড়া শিক্ষা করতে পারেননি। এমনকি বাঁশি সর্ম্পকে তাত্ত্বিক ধারনাও নেই তার,তবে স্কেল অনুসারে তিনি বাঁশি বাজাতে পারেন এবং যে কোনো গানের সুরও তুলতে পারেন। তিন রকমের বাঁশি বিক্রি করেন রহমত আলী। আড়বাঁশি,মোহনবাশি ও মুখবাঁশি। তবে আড়বাঁশি বাজিয়ে তিনি লোক জড়ো করেন। অথবা বাঁশি বাজাতে বাজাতেই পথ চলতে থাকেন। এসময় যার বাঁশি কেনা প্রয়োজন হয় তখন সে তাকে কাছে ডেকে এনে বাঁশি কেনেন।
অনেক কথার মাঝখানে বিদায় বেলায় দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বাঁশিওয়ালা রহমত আলী বলেন,শুনেছি সাংস্কৃতিক কর্মীদের সরকার অনুদান হিসেবে সম্মানি ভাতা দেয়,কিন্তু আমি কোন ভাতা পাইনা। অথচ সাংস্কৃতিক কর্মীর ভুয়া পরিচয় তুলে অনেকে প্রতি বছর ভাতা তুলে খাচ্ছে,আর আমি প্রকৃত একজন সাংস্কৃতিকর্মী হিসেবে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করেও আমার কপালে সম্মানি ভাতা জোটেনি। বাঁশিওয়ালা রহমত আলীর প্রশ্ন? তাহলে প্রকৃত সাংস্কৃতিককর্মীর মূল্যায়ন কোথায়? তিনি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সুদৃষ্টি কামনা করছেন।