এম.দুলাল উদ্দিন আহমেদ,সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে উর্বর ফসলি জমিতে অসংখ্য পুকুর খননের কারণে জলাবদ্ধতায় অনাবাদী হয়ে পড়েছে হাজার বিঘা কৃষি জমি। চাষাবাদ করতে না পেরে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে শত-শত পরিবার। উল্লাপাড়া কৃষি সম্প্রসারণ অফিস সূত্র জানায়,পুকুর খননের কারণে উপজেলার মোট আবাদী জমির এক শতাংশ সম্পূর্ণ হারিয়ে গেছে। আগামী ফাল্গুন-চৈত্র মাস পর্যন্ত পানি জমে থাকায় অনাবাদী থাকছে কয়েক শ বিঘা কৃষি জমি। এ কারণে ফসলের গড় লক্ষ্যমাত্রা ঠিক রাখা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। কিন্তু এত কিছু ক্ষতির আশঙ্কা থাকার পরও থামছে না কৃষিজমিতে নির্বিচারে অপরিকল্পিত পুকুর খনন। এ বছর এলাকার কয়েকটি চক্র শতাধিক পুকুর খননের প্রস্তুতি নিয়েছে। রাতদিন চলছে খনন যন্ত্র (এক্সকাভেটর) দিয়ে পুকুর খননের কাজ। এলাকাবাসী বারবার উপজেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েও কোনো প্রতিকার পায়নি।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের কচিয়ার বিল এলাকায় প্রায় পাঁচ বছর আগে পুকুর খনন শুরু হয়। দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। ক্রমান্বয়ে এলাকায় চলতি বছর পর্যন্ত পায় ৪০০ পুকুর খনন হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়কের ২ নম্বর ব্রিজ দিয়ে পানি প্রবাহের পথ। রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আকবর আলী জানান, জলাবদ্ধতার কারণে ফসলহানী হওয়ায় নিরুপায় কৃষক পুকুর খননের দিকে ঝুঁকে পড়ছে বাধ্য হয়েই। এ সুযোগ প্রভাবশালীরা উচ্চমূল্যে লিজ নিয়ে বড় বড় পুকুর খনন করেই চলেছে।
দক্ষিণ পূঁস্তিগাছা গ্রামের কৃষক মজিবর রহমান অভিযোগ করে বলেন, প্রভাবশালীরা কচিয়ার বিলে ৫০ বিঘা আয়তনের দুটি পুকুর খনন করছে। যা নিয়ে তিনিসহ এলাকাবাসী গণস্বাক্ষর করে পুকুর বন্ধের আবেদন জানিয়ে গত ২৫ সেপ্টেম্বর উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন। কিন্তু তাতে প্রতিকার মেলেনি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নে অসংখ্য পুকুর খনন করা হয়েছে এবং বর্তমানেও খনন করা হচ্ছে। অপরদিকে রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়ন সংলগ্ন দক্ষিণ পাশের বাঙ্গাল ইউনিয়নের মোহনপুর, বয়রা হয়ে চেংটিয়ার শৈল ধূপরিয়া বিল। এ বিল দিয়েই মূল চলনবিলে প্রবাহিত হয় উপজেলার উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের পানি। অথচ এ বিলের মাঝে পানি প্রবাহের পথেই ধরইল গ্রামের বাসিন্দা,চিহ্নিত ভূমিদস্যু উত্তম সরকার লিজ নিয়ে শত বিঘার ২টি পুকুর খনন করে। দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। এ সুযোগে উত্তম গং এলাকার আরো অন্যান্য কৃষকদের জমি লিজ নিয়ে ওই বিলে আরো ১০০ বিঘার পুকুর খনন চলমান রেখেছেন। এ বিষয়ে এলাকার কৃষক বারবার অভিযোগ করলেও উপজেলা নির্বাহী অফিসার উজ্জল হোসেন তা আমলে নেননি। বরং অভিযোগ ছুটির দিনগুলোতে দেখা যায় তিনি উত্তম সরকারের পুকুরে হুইল দিয়ে মাছ ধরেন। অথচ পুকুরের সংলগ্ন মাত্র ৫ ফুট দূরত্বে কৃষি জমিতে উত্তম সরকার আরেকটি শত বিঘার নতুন পুকুর খনন করছে।
চেংটিয়া গ্রামের কৃষক আব্দুল আলীম অভিযোগ করে বলেন, এ মাঠে তার ৬ বিঘা আবাদি জমি রয়েছে। জলাবদ্ধতার কারণে শ্রমিক দিয়ে কচুরি পানা সাফ করছি। এ বছরে এসব জমিতে আর সরিষার আবাদ করা সম্ভব হবে না। এসব পুকুর খনন করা হলে স্থায়ী জলাবদ্ধতায় আমার জমিতে আর কোনো প্রকার ফসলই হবে না।
সরেজমিনে চেংটিয়া গ্রামের শৈল ধুকুরিয়া বিলে গিয়ে দেখা যায়,শত বিঘা আয়তনের একটি পুকুর খনন চলমান রয়েছে। এ সময় সাংবাদিকদের দেখে এগিয়ে আসেন ওয়ার্ড আওয়ামী যুবলীগের সভাপতি ফজলুর রহমান। তিনি নিজেকে উত্তম সরকারের পার্টনার পরিচয় দিয়ে বলেন, ইউএনও তাদের পুকুরে মাছ ধরেন এ কারণে তিনি কিছু বলবেন না। এমনকি প্রশাসনের সকল সেক্টর ম্যানেজ ফলে কোনো সমস্যা নেই।
বাঙ্গালা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সোহেল রানার কাছে এ প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন,আমার কাছে কেউ কোনো অভিযোগ দেয়নি। পুকুর খননের কোনো চিত্র আমার চোখে পড়েনি।
উল্লাপাড়া কৃষি অফিসার সুবর্ণা ইয়াসমীন সুমি বলেন, এ উপজেলায় মোট আবাদী জমির পরিমাণ ৩২ হাজার ৫৮৫ হেক্টর। এরমধ্যে গড়ে এক ভাগ কৃষিজমি পুকুর খননে হারিয়ে গেছে। যার পরিমাণ ৩২৫ দশমিক ৮৫ হেক্টর।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার উজ্জল হোসেন বলেন,উত্তম সরকার একজন সফল মৎস্য ব্যবসায়ী। তাকে ভূমিদস্যু বলা ঠিক নয়। তবে স্থানীয়রা অভিযোগ দিয়েও কোন প্রতিকার পাচ্ছেন না এমন অভিযোগের বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যান।
জেলা প্রশাসক ড. ফারুক আহম্মদ বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। জেনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।