এম.দুলাল উদ্দিন আহমেদ,সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি:
কোন কর্মই যে ছোট নয় তার উজ্জল দৃষ্টান্ত বীরমুক্তিযোদ্ধা অমর আলী। মহান মুক্তিযুদ্ধের সম্মুখযোদ্ধা অমর আলীর বাড়ী সিরাজগঞ্জ শহরের কোঁলঘেষে অবস্থিত রামগাঁতী গ্রামে। পাক হানাদার বাহিনীকে পরাভুত করে বীরের খেতাব অর্জনকারী অমর আলী দারিদ্রতার কারণে আজ পেশা হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন রিকসা। কাকডাকা ভোর থেকে শুরু করে রাত ৮/১০ টা পর্যন্ত তিনি রিকসা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। শহরে বের হলেই দেখা মেলে হাসিমাখা বীরমুক্তিযোদ্ধা অমর আলীর।
সাম্প্রতিক সময়ের কোন একদিন বিকেল বেলা বাজার স্টেশন থেকে যখন আমি দেশের এই গর্বিত সন্তানের রিকসায় চড়ে গোশালার দিকে যাচ্ছিলাম তখনও আমি বুঝতে পারিনি তিনি একজন বীরমুক্তিযোদ্ধা। তবে রিকসার সিটে বসে চলন্ত পথে তার বয়স বিবেচনা করে যখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম বাবাজি আপনি এই বৃদ্ধ বয়সে রিকসা চালাচ্ছেন কেন? আপনার কি কোন ছেলে মেয়ে নেই? এসময় তিনি মুচকি হেঁসে বললেন বাবা আমার ১ছেলে ও ৭ মেয়ে। এভাবে তার সাথে কথা বলতে বলতে যখন টিবি হাসপাতালের সন্নিকটে তখন তিনি বললেন রামগাঁতীর পরও এই টিবি হাসপাতালের পিছনেও রয়েছে আমার একটি বাসা। আবার কিছুদুর গিয়ে তিনি হাত দিয়ে দেখালেন আব্দুল মান্নান তালুকদারের সোঁনালী আঁশের দক্ষিন পাশের এই বিল্ডিংটি তার ছেলের ।
এসময় আমি তাকে আবারো প্রশ্ন করলাম বাবাজি তাহলে আপনি কেন রিকসা চালাচ্ছেন ? তখন উত্তরে তিনি বললেন বাবা আমি ছোট বেলা থেকেই বাবার অধীন ছাড়া পারাধীন জীবন পছন্দ করিনা। এমনকি হালাল রুজি ব্যতিত অন্য কোন রুজিতেও আমি বিশ্বাসী না। কাজেই আমি ছেলের অধীন না হয়ে নিজে রিকসা চালিয়ে হালাল পথে জীবিকা নির্বাহ করছি এবং পরাধীন না হয়ে স্বাধীনভাবে চলছি। সেইসাথে আমি একজন বীরমুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সরকারিভাবে প্রাপ্ত ২০ হাজার টাকার সম্মানী ভাতার পাশাপাশি রিকসা চালিয়ে যে আয় করছি তা দিয়েই স্বাচ্ছন্দে চালাচ্ছি সুখের সংসার।
সংসার যুদ্ধে টিকে থাকার সংগ্রামে দু’হাতে হ্যান্ডেল ও দু’পায়ে রিকসার প্যান্ডেল থাকা দেশের শ্রেষ্ট এই প্রিয় মানুষটি কখনোই গর্ব করে বলেন না আমি বীরমুক্তিযোদ্ধা। তার ভাষ্যমতে নিজের পরিচয় জাহির করার প্রয়োজন নেই, কারণ পরিচয় ফুঁটিয়ে তুলতে হয় নিজের কৃতকর্মের মাধ্যমে,প্রচার করে নয়। সাদা মনের অধিকারী নম্র-ভদ্র-বিনয়ী ও নির্লোভী বীরমুক্তিযোদ্ধা অমর আলীকে তার রনাঙ্গনের সহযোদ্ধারা ছাড়া সিরাজগঞ্জ শহরের মানুষ তাঁকে রিকসাচালক হিসেবে চেনেন আর এতেই তিনি গর্ববোধ করেন। অথচ ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ভারত থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দেশে এসে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে একজন সম্মুখ বীরযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন স্বাধীন সার্বভৌম একটি দেশের জন্য। কিন্তু তাঁর সেই মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়টি আজ চাপা পড়ে গেছে রিকশাওয়ালা পরিচয়ের মাঝে। এতে তার কোন আক্ষেপ ও দুঃখ নেই। তার স্বপ্ন তিনি যতোদিন বেঁচে থাকবেন ততোদিন তিনি সৎ পথে উপার্জন করে জীবিকা নির্বাহ করেই বেঁচে থাকবেন। আমৃত্যু তাকে যেন কোন অবৈধ অর্থ স্পর্শ করতে না পারে সে জন্যই তিনি আজ বৃদ্ধ বয়সে পা’য়ে রিকসার প্যান্ডেল মারছেন।
স্তম্ভিত হয়ে অপলকদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে শুনছিলাম আমি সহজ-সরল মনের সুন্দর দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব বীরমুক্তিযোদ্ধা অমর আলীর সাদা মনের কথাগুলো। যে সাবলিল ভাষার কথাগুলো সুন্দর ও আদর্শ জীবন গড়তে প্রতিটি মানুষকে উৎসাহিত-অনুপ্রাণিত করবে। তবে সুন্দর আগামীর পথচলতে বীরমুক্তিযোদ্ধা অমর আলীর নিকট থেকে আমাদের অনেক শিক্ষা গ্রহণ করার রয়েছে। কেননা কোন কর্মকে যে ছোট করে দেখতে নেই তার উজ্জল দৃষ্টান্ত হলেন বীরমুক্তিযোদ্ধা অমর আলী। অথচ সততার স্বাক্ষর রাখা অমর আলীদের কথা কেউ স্মরণ করেনা। তবে বীরমুক্তিযোদ্ধা অমর আলীসহ এমন যারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তাদের এ বয়সে পায়ে রিকসার প্যান্ডেল আর হাতে হ্যান্ডেল দেখতে চায়না এসমাজ। বীরমুক্তিযোদ্ধা অমর আলীসহ এমন যারা রয়েছে তারা কারোর দারস্থ হতে ও হাত পাততে চায়না,তারা জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পুর্ব পর্যন্ত বীরের মতো মাথা উঁচু করেই শারীরিক শ্রম বিক্রি করে বেঁচে থাকতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। তারপরও বয়স বিবেচনা করে তাদেরকে পুণর্বাসিত করার জন্য সমাজ বা সরকারের স্বপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসা উচিত। সুতরাং এ বৃদ্ধ বয়সে যেন বীরমুক্তিযোদ্ধা অমর আলীর মতো যারা রয়েছে তারা যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারে সে বিষয়ে সমাজের বিত্তবানসহ সরকারের নজর দেওয়া প্রয়োজন। স্যালুট জানাই মহান মুক্তিযুদ্ধের গর্বিত সন্তান অমর আলীকে।