আমিনুল ইসলাম হিরো;
চন্দ্র মাসের ১১ রবিউস সানি পীরানে পীর বড় পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)’র ওফাত বার্ষিকী। তিনি কাদেরিয়া তরিকার ইমাম বিশ্বখ্যাত সুফি দরবেশ।
বাগদাদবাসী তাঁকে শায়খ হিসেবে সম্বোধন করে থাকে। শায়খ অর্থ প্রধান, বুদ্ধিমান বৃদ্ধ, মুখ্য, সদর, শীর্ষস্থানীয়। বড় রাস্তা থেকে তাঁর মাজার কমপ্লেক্সের দিকে যেতে প্রকান্ড গেইট রয়েছে। বাগদাদে যে কোন টেক্সীওয়ালাকে বাবুশ শায়খ বললে এক বাক্যে চিনে নেয়। অর্থাৎ শায়খ এর গেইট। হযরত পীরানে পীর ছিলেন কাদেরিয়া তরিকার ইমাম। তিনি (রহ.) ৪৭০ হিজরি তথা ১০৭৭-৭৮ খ্রিস্টাব্দে ১ রমজানে ইরানের গিলান অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন।
হযরত ইমাম হাসান (র.)’র বংশে তাঁর মাতা এবং ইমাম হোসাইন (র.)’র রক্ত প্রবাহে রয়েছে তাঁর পিতা। এ কারণে হযরত পীরানে পীর (রহ.) কে আল হাসানী ওয়াল হোসাইনী বলা হয়ে থাকে। ঐতিহাসিকগণ তথা ধর্মীয় বিজ্ঞগণ একমত পোষণ করেন যে, পীরানে পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) বিশ্বের ইতিহাসে অতুলনীয় রুহানী শক্তির অধিকারী ছিলেন এবং তা তাঁর মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থা হতে প্রতিফলন ঘটতেছিল।
হযরত পীরানে পীর (রহ.) উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের লক্ষে নিজ জন্মভূমি গিলান অঞ্চল থেকে বাগদাদে গমন করেন। তথায় নিজামিয়া মাদ্রাসা থেকে সর্বোচ্চ সনদ লাভ করেন। এবাদতবন্দেগীতে নিজেকে মশগুল রাখতেন। বছরের পর বছর এশারের নামাজের অযু দ্বারা ফজরের নামাজ আদায় করেছেন। বহু বছর রাত্রিকালে নফল নামাজে দাঁড়িয়ে কুরআন মাজীদ খতম করেছেন।
তিনি শৈশবেই নিজের অস্তিত্ব ও আমিত্ব ভুলে গিয়ে নফসের কামনা বাসনাকে সম্পূর্ণরূপে দমন করে আল্লাহ তাআলার সহিত অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেন। আল্লাহ তাআলার বিধি নিষেধ পূর্ণরূপে মেনে চলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। আল্লাহ তাআলার ইচ্ছার মধ্যে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে বিলীন করে দেন।
মূলত বিশ্বের ইতিহাসে পীরানে পীর বড় পীর হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.)’র এত বেশি কারামত বিভিন্ন গ্রন্থে লিখিত রয়েছে যে, তা আর কারও আছে বলে মনে হয় না। তিনি ওলিগণের সর্দার, পীরগণের পীর, ইমামগণের ইমাম হিসেবে জনগণের কাছে স্বীকৃত।
তিনি সহজে মানুষের হাদিয়া গ্রহণ করতেন না। কেউ কিছু দিলে অন্যদের মাঝে বিলিয়ে দিতেন। বাগদাদের খলিফা মনসুরের পুত্র ইউসুফ এক থলি স্বর্ণ মুদ্রা উজিরের মাধ্যমে পাঠান, কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। সপ্তাহে ৩ দিন নসিহত করতেন। শুক্রবার জুমার পর মসজিদ প্রাঙ্গণে, শনিবার রাতে মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে, বুধবার বাদ ফজর ঈদগা ময়দানে। খলিফা থেকে আরম্ভ করে জ্ঞানী-গুণী, আলেম-ফাজেল, সুফি-দরবেশ, ইহুদি-খ্রিস্টান-মুশরিক, কুলি-মজুর লোকে লোকারণ্য হয়ে যেত। তাঁর নসীহত শুনতে শুনতে হাজার হাজার মানুষ আত্নহারা হয়ে যেত।
হিজরি ৫২১ খ্রিস্টাব্দ থেকে হিজরি ৫৬১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শিক্ষা দীক্ষা কাজে মশগুল ছিলেন। তাঁর অসংখ্য কারামতের মধ্যে এটা একটি ছিল যে, সে সময় হাজার হাজার শ্রোতা সামনে পেছনে সবাই এক সমান আওয়াজ শুনতে পেত।
হযরত আবদুল কাদের জিলানী অনেক অমূল্য গ্রন্থ রচনা করে গেছেন। তৎমধ্যে কয়েকটি হল-(১) গুন্ইয়াতুত ত্বালেবীন (২) আল-ফাত্হুর-রাব্বানী (৩) ফুতহুল গুয়ুব (৪) হিযবুল বোশাইরী (৫) জিয়াউল খাতির (৬) আল-মাওয়াহিবুর-রাহমানিয়া (৭) ওয়াকেয়াতুল হিকাম (৮) আল- ফায়েদাতুর রাব্বানিয়া ফিল-আওরাদিল কাদিরিয়া (৯) বাহ্জাতুল আসরার।
অধিকাংশ জ্ঞানীগুণী লেখকেরা তাঁকে অতি উচ্চ মর্যাদাবান ব্যক্তি বলে উল্লেখ করে গেছেন এবং তাঁকে নানান লক্ববে ভূষিত করেন। তৎমধ্যে ওলি দরবেশগণের সুলতান অন্যতম। যথা- পীরানে পীর, তথা পীরগণের পীর।
হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) এত উন্নত ও উচ্চতর মর্যাদার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তিনি সীমাতিরিক্ত বিনয়ী ছিলেন। একটি শিশু কিংবা একটি বালিকাও তাঁর সাথে কথা বললে তিনি দাঁড়িয়ে তা শুনতেন এবং তাঁর ফরমায়েশ মুতাবিক কাজ করে দিতেন। অভাবী ও দরিদ্র শ্রেণীর লোকদের নিকট তিনি বসতেন এবং তাদের কাপড়-চোপড় পরিষ্কার করে দিতেন।
অপরদিকে কোন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি কিংবা সাম্রাজ্যের কোন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের সম্মানার্থে তিনি দাঁড়াতেন না। খলিফার আগমন ঘটলে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই আপন গৃহ অভ্যন্তরে চলে যেতেন এবং খলিফা এসে উপবেশন করলে পর সেখান থেকে বেরিয়ে আসতেন যাতে খলিফার সম্মানার্থে দাঁড়াতে না হয়। তিনি কখনও উজির কিংবা সুলতানের দরজায় গিয়ে দাঁড়াননি। ইমাম হাফিজ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবন ইউসুফ আল-বারযালী আল আশবেলী তাঁর প্রশংসায় বলেনঃ
তিনি যে দোয়া করতেন তা কবুল হত অর্থাৎ তিনি মুস্তাজাবুদ্দাওয়াত ছিলেন। যার পরিণতি থেকে শিক্ষা ও উপদেশ গ্রহণ করা যায় এমন কোন ঘটনার কথা উঠলে তাঁর চোখ সহসাই অশ্রুসজল হয়ে উঠত। তিনি আল্লাহর যিকর ও ফিকরে মগ্ন থাকতেন। তাঁর অন্তঃকরণ ছিল খুবই কোমল। তিনি ছিলেন উদার, দানশীল, ব্যাপক ও বিস্তৃত জ্ঞানের অধিকারী, উচ্চ বংশজাত এবং ‘ইবাদত-বন্দেগী ও রিয়াজত-মুজাহাদার ক্ষেত্রে অনন্য। ক্ষুধার্তকে খাবার খাওয়াতে ও অভাবী লোকদের প্রয়োজন পূরণে তিনি দেদার অর্থ ব্যয় করতেন এবং এতে আনন্দ পেতেন।
আল্লামা ইবনুল-নাজ্জার শায়খ জিলানী (রহ.) থেকে বর্ণনা করেন: গোটা দুনিয়ার সমস্ত সম্পদই যদি আমার হাতে চলে আসে তাহলে আমি সবটাই ক্ষুধার্তদের মধ্যে বিলিয়ে দেব। শায়খ (রহ.) এর নির্দেশ ছিল, রাতের বেলা প্রশস্ত দস্তরখানা বিছানো হবে। তিনি নিজে মেহমানদের সাথে বসে খানা খেতেন, গরিব ও দুর্বল লোকদের সঙ্গ দিতেন এবং ছাত্রদের জিজ্ঞাসাসমূহ ধৈর্য সহকারে শুনতেন।
আল্লাহ তাআলা তাঁর কলবের তাওয়াজ্জুহ ও মুখের তা’ছীরে লাখো মানুষকে ঈমানী জিন্দেগী দান করেছেন। তাঁর অস্তিত্ব ছিল ইসলামের জন্য বসন্ত সমীরণের ন্যায় যা মৃত দিলের মাঝে নবতর প্রাণ-স্পন্দন সৃষ্টি করেছে এবং মুসলিম জাহানে ঈমান ও আধ্যাত্মিকতার এক নতুন জোয়ার বইয়ে দিয়েছে।
শায়খ উমর কিসানী বলেন: শায়খের এমন কোন মজলিস বসত না যেখানে ইয়াহূদী ও খ্রিস্টানদের কেউ না কেউ ইসলাম গ্রহণ না করত। ডাকাত, খুনি ও নানাবিধ পাপে লিপ্ত লোকেরা তওবাহর সৌভাগ্য লাভ করত এবং ভ্রান্ত আকীদা-বিশ্বাসের লোক তাদের ভ্রান্ত আকীদা বিশ্বাস থেকে তওবাহ করত।
ঐতিহাসিকদের মতে, বাগদাদে বসবাসকারীদের একটি বিরাট অংশ হযরত শায়খ (রহ.) এর হাতে হাত রেখে তওবাহ করেছিলেন এবং বিরাট সংখ্যক ইয়াহূদী, খ্রিস্টান ও যিম্মী তাঁর হাতেই মুসলমান হয়েছিলেন।
হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) ৭৩ বছর বাগদাদে অতিবাহিত করেন। এ সময়ের মধ্যে পাঁচজন আব্বাসী খলিফা তাঁর চোখের সামনেই একের পর এক খেলাফতের আসনে সমাসীন হন। যখন তিনি বাগদাদে আগমন করেন তখন ছিল খলিফা মুস্তাজহির বিল্লাহ আবুল আব্বাসের যুগ ৫১২ হিজরি তারপর মুস্তারশিদ, রাশেদ, আল-মুকতাদী লি আমরিল্লাহ ও আল-মুস্তানজিদ বিল্লাহ যথাক্রমে খলিফার আসনে সমাসীন হন। হযরত আবদুল কাদের জিলানী (রহ.) এর এই যুগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনাবলীতে ভরপুর।
তিনি দুনিয়ার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে ঈমানী চেতনার পুনরুজ্জীবন, পারলৌকিক জীবনের গুরুত্ব, অনুপম চরিত্র, নির্ভেজাল তওহীদ ও পরিপূর্ণ ইখলাসের সাথে দাওয়াত প্রদানের ওপর তাঁর সমগ্র শক্তি নিয়োজিত করেন।
তিনি জীবনের শেষ বয়সে বাগদাদ থেকে জন্মভূমি গিলানে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাগদাদবাসীর অতি আবদার অনুরোধ উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি। বিশ্বখ্যাত এ মহান ওলি পীরানে পীর ৫৬১ হিজরি ১১৬৬ খ্রিস্টাব্দে ১১ রবিউস সানি প্রায় ৯১ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। বাগদাদ নগরীর প্রাণকেন্দ্রে বিশাল মাজার কমপ্লেক্স নিয়ে তিনি শায়িত আছেন।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিষ্ট
rofiqul.nayem@gmail.com