মঈন উদ্দীন, রাজশাহী থেকে হাড়িয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী বাশের তৈরী আশবাব পত্র। কারিগররা অভাবের তারনায় দীর্ঘ দিনের বাপ দাদার পেশা ছেড়ে অনেকে অন্য পেশায় চলে যাওয়া এ শিল্প এখন বিলুপ্তির পথে। হাতে গোনা কিছু বাঁশ শিল্প কারিগরগণন অভাব অনটনের মাঝে আজও বাপ দাদার পেশা ধরে রেখেছেন। পুরুষের পাশা পাশি নারী কারিগররাও জীবিকা নির্বাহের জন্য ছেলে মেয়েদের নিয়ে অতি কষ্টে বাঁশ বেতের কাজ করে যাচ্ছেন। বর্তমানে বাজারে প্লাষ্টিকের পণ্য ও অন্যান্য দ্রব্য মূল্যের সাথে পাল্লা দিতে না পারায় তাদের পেশায় মুখ থুবরে পড়েছে।
বরেন্দ্র অঞ্চলে কৃষিকাজের অন্যতম জিনিসপত্র একসময় তৈরি হয়েছে বাঁশ ও বেত দিয়ে। সহজে বনবাদাড় থেকে এই উপকরণগুলো সংগ্রহ করে মাথায় দেওয়া মাথালি, শস্য ঝাড়াইয়ের কুলা, টুকরি, ধামা, কুলা, চালনি, খাচা, চাটাই, ডালা, ঝুড়ি, চেয়ার, পাখা, টোপাসহ প্রাকৃতিক বাঁশ দিয়ে তৈরি ইত্যাদি তৈরি করতেন কারিগররা। রাজশাহী কৃষি অঞ্চল নাটোর, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জে এসব পণ্য বেশ দেখা মিলতো। বর্তমানে বিলুপ্তির পথে রাজশাহীর এই বাঁশ শিল্প।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, অপ্রতুল ব্যবহারে আর বাঁশের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বাঁশ শিল্পীরা তাদের বাপ-দাদার পৈত্রিক পেশাকে ছেড়ে অন্যান্য পেশা বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। হাতে গোনা কয়েকজন শিল্পের কারিগররা নিরুপায় হয়ে ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে রাখার প্রাপপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
জেলার প্রাকৃতিক জীবকুল ও পরিবেশ বিপর্যয় বাঁশ চাষে প্রয়োজনীয় পুঁজি ও ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার কারণে বিলুপ্ত হতে বসেছে এ শিল্প। অন্যদিকে দেশীয় প্লাষ্টিকের বাজার জমজমাট হওয়ায় এ পেশায় নিয়োজিতরা বর্তমান বাজারে প্লাষ্টিক পণ্য ও অন্যান্য দ্রব্যের সাথে পাল্লা দিতে না পারায় তাদের কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে।
যার কারণে গ্রাম থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার ঐতিহ্যবাহী বাঁশ শিল্প। এক সময় বাঁশ শিল্প এলাকার প্রতিটি ঘরে ঘরে বাঁশের তৈরি সামগ্রীর কদর ছিল খুব বেশি। কিন্তু কালের পরিবর্তনের হাওয়ায় এখন তা আর বিশেষ চোখে পড়ে না।
কালের পরিবর্তনের সাথে সাথে বাশের সামগ্রী ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। অপ্রতুল ব্যবহার এবং বাশের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারনে বাঁশ শিল্প আজ হুমকির মুখে। এসব বাশের তৈরী সামগ্রী বাচ্চাদের দোলনা, পাখা, ঝাড়ু, ঢালি, কুলা, চালুনসহ বিভিন্ন প্রকার আসবাব পত্র গ্রামাঞ্চলে প্রতিটি ঘরে ঘরে কদর ছিল।
কারিগররা বলছেন, যে বাঁশ এক সময় ৫০ থেকে ৮০ টাকায় কিনা যেত সে বাঁশ এখন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। বাশের দাম যে পরিমানে বেড়েছে সে পরিমানে বাড়েনি বাশের তৈরী পণ্যের দাম। জনসংখ্যা বৃদ্ধিসহ ঘর বাড়ী নির্মাণে যে পরিমান বাশের প্রয়োজন সে পরিমান বাশ উৎপাদন হচ্ছে না।
প্রবিন পরিবেশবিদরা বলছেন, এক সময়ে মানুষ একটু ফুরসত পেলেই বাঁশের মাচা, মই, চাটাই, ঢোল, গোলা, ওড়া, বাউনি, ঝুড়ি, ডুলা, মোড়াসহ বিভিন্ন ঘরের কাজে ব্যবহৃত জিনিসপত্র বানাতে বসে পড়তো। গ্রাম-বাংলায় এখন আর এমন দৃশ্য চোখে পড়ে না। তারা বলেন, সাধারণত গ্রামের লোকেরাই এ শিল্পের সাথে জড়িত ছিল বলেই এ শিল্পকে গ্রামীণ লোকশিল্প বলা হয়।
তারা আরো বলেন, আগের তুলনায় পরিমান মত বাঁশের জন্ম বা উৎপাদন সঠিকভাবে হচ্ছে না। অন্যদিকে বাঁশের ব্যাপক চাহিদা থাকার কারণে বংশবৃদ্ধির আগেই তা উজাড় করে কাটা হচ্ছে এসব বাঁশ। আশির দশকে গ্রামের বেশীর ভাগ ঘর বাড়িই বাঁশের সাহায্যে তৈরি করা হতো। একটি ঘর তৈরি করতে বাঁশ লাগত প্রায় ৪০ থেকে ৫০টি। রাজশাহী অঞ্চলের গ্রামগুলোতে এসব শিল্পের চাহিদা ছিল অনেক বেশি। বিগত কয়েক বছর ধরে এ শিল্পের ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক। এ পেশায় দক্ষ শিল্পীদের পরিবারে দেখা দিয়েছে চরম দুরাবস্থা। যার ফলে কুটির শিল্পের উপর নির্ভরশীল পরিবারে চলছে দুর্দিন। বেকার হয়ে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে।