এম.দুলাল উদ্দিন আহমেদ;
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের মহানায়ক মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ ও বাংলা সাহিত্যাকাশের উজ্জল নক্ষত্র নজিবর রহমান সাহিত্যরত্নের জন্মভুমি যমুনা বিধৌত সিরাজগঞ্জ জেলার ঐতিহাসিক সলঙ্গা থানাধীন হাটিকুমরুল নবরত্ন মন্দিরটি এখন পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়ছে এবং নবরুপে আলো ছড়াচ্ছে। প্রায় পাঁচশ বছরের পুরনো এই মন্দির অত্র এলাকার ঐতিহ্য ও জনপদের না বলা ইতিহাস বুঁকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্থানীয় পর্যটক ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রেমীদের পদচারণায় প্রতিদিন মুখড়িত হয়ে ওঠে মন্দির এলাকা। দিনাজপুরের কান্তজি মন্দিরের মতো এই মন্দিরের প্রচার খুব একটা নেই বলে অনেকের কাছেই এটি এখনও অদেখা। স্থানীয়ভাবে দোলমঞ্চ নামে পরিচিত,এটাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নবরত্ন মন্দির।
ঢাকা-বগুড়া মহাসড়কের হাটিকুমরুল বাস স্টেশনের কোঁলঘেঁষে দুইপাশের ধান ক্ষেত আর গ্রামীণ সবুজ জনপদ পেরিয়ে ছোট্ট একটি পিচ ঢালাই পথ আঁকাবাঁকা হয়ে চলে গেছে উত্তর পূর্ব দিকে। এই পথে প্রায় অর্ধ কিলোমিটার গেলেই দেখা মিলবে পোড়ামাটির কাব্যে গাঁথা অনন্য এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। কারুকার্যমন্ডিত নবরত্ন মন্দিরটি ৩ তলা বিশিষ্ট। এই মন্দিরের আশে পাশে আরও তিনটি মন্দির রয়েছে। পোড়ামাটির ফলক সমৃদ্ধ ৯টি চূড়া থাকায় এটিকে নবরত্ন মন্দির বলা হয়। বর্তমানে ৯টি চূড়ার প্রায় সবগুলোই ধ্বংসপ্রায়। এক সময় মন্দিরের মূল স্তম্ভের উপরে পোড়ামাটির সুশোভিত চিত্র ফলক। ফুল, ফল, লতাপাতা আর দেবদেবীর মূর্তি খচিত এই ফলক মধ্যযুগীয় শিল্পকর্মে পরিপূর্ণ ছিল। সংস্কার ও কালের বিবর্তনে ওইসব এখন নেই বললেও চলে। বর্গাকার এই মন্দিরের আয়তন প্রায় ১৬ স্কয়ার বর্গমিটার। বর্গাকার মন্দিরের মূল কক্ষটি বেশ বড়। নীচতলায় ২টি বারান্দা বেষ্টিত একটি গর্ভগৃহ। এর বারান্দার বাইরের দিকে ৭টি এবং ভিতরের দিকে ৫টি প্রবেশ পথ।
দিনাজপুরের কান্তজি মন্দিরের সঙ্গে প্রবেশ পথের সংখ্যার পার্থক্য দিয়ে এই মন্দিরকে সহজে চিনে নেয়া যায়। গর্ভগৃহের পূর্ব ও দক্ষিন দিকে ২টি প্রবেশ সুরঙ্গ পথ আর মন্দিরের ২য় তলায় কোন বারান্দা নেই। মন্দিরের প্রবেশ পথ পূর্ব দিকে, কুঠুরীর উত্তরে ওপরে উঠার সিঁড়ি। ভিতর থেকে মূল ভবনের উপরের ছাদ গোলাকার গম্বুজ। এ মন্দিরের প্রতিটি ইট ঘিয়ে ভেজে তৈরি করা হয়েছিল বলে স্থানীয়ভাবে শোনা যায়। নবরত্ন মন্দিরটি ‘সংরক্ষিত ঐতিহাসিক স্থান’ হিসেবে সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ গ্রহণ করে ১৯৮৭ সালে কিছু সংস্কার করে। পর্ববর্তীতে তা পুরোপুরি সংস্কারসহ মন্দিরে যাওয়ার আঁকাবাঁকা মেঠো পথটিও পাকা করা হয়েছে। নবরত্ন মন্দিরটি যেন এখন নবরুপে আলো ছড়াচ্ছে।
সিরাজগঞ্জের সলঙ্গার এই নবরত্ন মন্দিরসহ আশে পাশের মন্দিরগুলো আনুমানিক ১৭০৪-১৭২০ সালের মধ্যে নবাব মুর্শিদকুলি খানের শাসন আমলে তার নায়েব দেওয়ান রামনাথ ভাদুরী নামক ব্যক্তি তৈরি করেন। বিভিন্ন সূত্রমতে, মথুরার রাজা প্রাণনাথের অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন জমিদার রামনাথ ভাদুরী। মথুরার রাজা প্রাণনাথ দিনাজপুর জেলার ঐতিহাসিক কান্তজির মন্দির নির্মাণে বিপুল অর্থ ব্যয় করে অর্থ সংকটে পড়ে যান, এতে করে তিনি বাৎসরিক রাজস্ব পরিশোধ করতে ব্যর্থ হন। এদিকে রামনাথ ভাদুরী মথুরা থেকে অর্থশূন্য হাতে ফিরে এসে, বন্ধুত্বের খাতিরে নিজ কোষাগার থেকে টাকা দিয়ে রাজা প্রাণনাথের বকেয়া দিনাজপুরের কান্তজির মন্দিরের আদলে হাটিকুমরুলে ১টি মন্দির নির্মাণের শর্তে পরিশোধ করে দেন। শর্ত মোতাবেক রাজা প্রাণনাথ কান্তজির মন্দিরের অবিকল নকশায় হাটিকুমরুলে এ নবরত্ন মন্দির নির্মাণ করে দেন।
আরেকটি তথ্যমতে,রাখাল জমিদার নামে পরিচিত রামনাথ ভাদুরী তার জমিদারি আয়ের সঞ্চিত কোষাগারের অর্থ দিয়েই এ মন্দির নির্মাণ করেন। তবে যেভাবেই তৈরি হোক,মন্দিরটি তার স্বরুপে এখনও আলো ছড়াচ্ছে। নবরত্ন মন্দিরের উত্তর পাশেই শিব-পার্বতী মন্দির,তার পাশেই রয়েছে দোচালা চণ্ডি মন্দির,দক্ষিণপাশে পুকুরের পাড় ঘেঁষে রয়েছে পোড়ামাটির টেরাকোটা কারুকার্যখচিত শিবমন্দির। সেগুলোও তাদের আকার ও নিজস্ব বৈশিষ্টের জন্য দেখার মতো।
বাস ও ট্রেনে সহজেই যাওয়া যাবে ওই মন্দির এলাকায়। ঢাকাসহ দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে বাসযোগে ওই মন্দিরে যেতে হলে সিরাজগঞ্জ রোড গোলচত্বর পেরিয়ে বগুড়া রোডের হাটিকুমরুল বাসস্ট্যান্ডে নামতে হবে। আবার সিরাজগঞ্জ রোড গোলচত্বরে নেমে সেখান থেকেও ভ্যান যোগে সরাসরি ওই মন্দিরে যাওয়া যাবে। এছাড়াও ট্রেন যোগে গেলে সিরাজগঞ্জের কড্ডা মুলিবাড়ী এম.মনসুর আলী অথবা উল্লাপাড়া রেলস্টেশনে নামতে হবে। সেখান থেকে সরাসরি বাসযোগে সিরাজগঞ্জ রোড গোলচত্বর অথবা হাটিকুমরুল বাসস্ট্যান্ডে নেমে সোঁজা পুর্বদিকে তাকালেই চোঁখের সামনে ভেসে উঠবে নবরত্ন মন্দির। বিশেষ করে নবরত্ন মন্দির দেখতে আসা পর্যটকরা সিরাজগঞ্জ রোড গোলচত্বর অথবা হাটিকুমরুল বাসস্ট্যান্ডে নামলে সেখানে তাদের মনকেড়ে নেবে স্থানীয় প্রসিদ্ধ গামছা ও লুঙ্গি। নবরত্ন মন্দির এলাকায় রয়েছে খাবারের জন্য আন্তর্জাতিক মানের ফুড ভিলেজ প্লাস,এ্যারিস্টোক্রেট, হানিফ হাইওয়ে ভিলা ও ফুড গার্ডেন হোটেল। এখানে রকমারি মিষ্টি এবং দইও কেনা যাবে। রাত্রী যাপনের জন্য আবাসিক হোটেলও আছে। তবে শাহজাদপুরে রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ি,সিরাজগঞ্জে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু যমুনা ইকোপার্ক, ইলিয়ট ব্রিজ, যমুনা পাড়ের হার্ড পয়েন্ট ও চায়না বাঁধসহ আরও দর্শণীয় স্থান দেখতে হলে রাত্রিযাপন করতে হবে সিরাজগঞ্জ শহরে। এয়ারকন্ডিশনড ও সাধারণ মানের বিভিন্ন আবাসিক হোটেল রয়েছে সিরাজগঞ্জ শহরে। ঢাকাসহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে সকাল সকাল রওয়ানা দিলে দিনেই ফিরে যাওয়া যাবে। সর্পোপরি নিরিবিলি ও গ্রামীণ পরিবেশে অবস্থিত নবরত্ন ওই মন্দির এলাকায় বেশ সময় কাটবে পর্যটকদের।
লেখক: সাংবাদিক,সাহিত্যিক,সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি এশিয়ান বার্তা টোয়েন্টিফোর ডটকম।
মোবা:০১৭১২-৪৯২০৮২,
ই-মেইল:dulal.sirajgonj@gmail.com