মঈন উদ্দীন, রাজশাহী: রাজশাহী অঞ্চলে একযুগে ধানের জমিতে ব্যাপক পরিমাণ ফলের উৎপাদন বেড়েছে। পাশাপাশি বৃদ্ধি পেয়েছে আবাসিক ভবন ও কলকারখানা নির্মাণ। এতে কমছে ধানের আবাদি জমি। তবে ধান গবেষণা কেন্দ্রের আঞ্চলিক দপ্তর ধানের বেশ কিছু জাত উদ্ভাবন করেছে এবং তাদের প্রচেষ্টায় কৃষিতে প্রয্ুিক্তর ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় ধানের জমির পরিমাণ কমলেও উৎপাদন তুলনামূলকভাবে বেড়েছে। ক্রমবর্ধমান হারে ধানের জমি ফলবাগানে পরিণত হলে অদূর ভবিষ্যতে নব সংকটের শঙ্কাও প্রকাশ করছেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা। লাভজনক অর্থকরি আবাদ হিসেবে ধানের পরিবর্তে ফলের বাগান গড়ে তোলার প্রবণতা বেড়েছে এ অঞ্চলে।
আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে এ অঞ্চলে ৮৭ হাজার ৩২ হেক্টর জমিতে ফলের বাগান ছিল। পাঁচ বছরের ব্যবধানে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৬ হাজার ৮৫৫ হেক্টরে। লাভজনক হওয়ায় কৃষক বাণিজ্যিক ফলবাগানে ঝুঁকেছেন। তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এক যুগ আগে থেকেই এই অঞ্চলে বাণিজ্যিক ফলবাগান বাড়ছে। এক যুগে এই অঞ্চলে ধান চাষের পরিধি কমেছে প্রায় ১ লাখ ৩৩ হাজার ৩৮২ হেক্টর। তবে উল্টো চিত্র উৎপাদনে। এই এক সময়ের ব্যবধানে ধানের উৎপাদন বেড়েছে ৩৪ হাজার ৮৫ টন।
রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ নিয়ে রাজশাহী কৃষি অঞ্চল। আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮-২০০৯ মৌসুমে এই চার জেলায় আউশ, আমন ও বোরো মিলে মোট ধানের আবাদি জমি ছিল ১০ লাখ ৭৩ হাজার ৯১৩ হেক্টর। ওই সময় ধান উৎপাদন হয়েছে ৩২ লাখ ৭০ হাজার ২৪৩ টন। অন্যদিকে ২০২১-২০২২ অর্থবছরে এই চার জেলায় মোট ধানের আবাদি জমি ছিল ৯ লাখ ৪০ হাজার ৫৩১ হেক্টর। তাতে ধান উৎপাদন হয়েছে ৩৩ লাখ ৪ হাজার ৩২৮ টন। ১৪ বছরের ব্যবধানে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৩৮২ হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ কমেছে। তবে এই সময়ে উৎপাদন বেড়েছে ৩৪ হাজার ৮৫ টন।
ধান গবেষণা কেন্দ্রের আঞ্চলিক দপ্তর সুত্রে জানাগেছে, রাজশাহী অঞ্চলে চাষের জন্য উপযোগী ধানের বেশ কিছু জাত উদ্ভাবন করেছেন তারা। খরাসহিষ্ণু জাত ব্রি ধান-৭১ ও পুষ্টি গুণাগুণ সম্পন্ন জিংক সমৃদ্ধ জাত ব্রি ধান-৭৪ এবং ব্রি ধান-৮৪ উদ্ভাবন করেছেন এখানকার বিজ্ঞানীরা। বোরো মৌসুমে অধিক ফলনশীল ব্রি ধান-৮১, ব্রি ধান-৮৮ এবং ব্রি ধান-৮৯ উদ্ভাবনেও এখানকার বিজ্ঞানীদের অবদান আছে। ব্রি-ধান-৭৫ উদ্ভাবনেও এখানকার বিজ্ঞানীরা বিশেষ ভুমিকা রেখেছেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ব্রি রাজশাহী অঞ্চলের প্রধান ড. ফজলুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ধানের নতুন নতুন জাত উদ্ভাবনে এখানকার বিজ্ঞানীরা কাজ করে যাচ্ছেন। এরই মধ্যে বেশ কিছু ধানের উন্নত জাত উদ্ভাবন হয়েছে। এগুলো এই অঞ্চলে চাষের উপযোগী। এখানে চাষ উপযোগী ব্রি হাইব্রিড ধান-৭ এবং ব্রি ধান-৯৮ উদ্ভাবন করা হয়েছে। রাজশাহীর গোদাগাড়ী এবং নওগাঁর মহাদেবপুরে এই ধান চাষ হয়। এই ধান তুলে গোদাগাড়ীতে টমেটো এবং মোহনপুরে আলু চাষ করেন কৃষকরা। সম্প্রতি ব্রি ধান-১০২ উদ্ভাবন হয়েছে। উচ্চ মাত্রার জিংক সমৃদ্ধ এবং রোগ প্রতিরোধী এই জাতটি চলতি বোরো মৌসুমে কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া হবে। কৃষকদের দিন বদলে দিয়েছে চাষের আধুনিক কৌশল ও উচ্চ ফলনশীল জাতের এসব ধান।
রাজশাহী আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক শামসুল ওয়াদুদ জানান, আধুনিক প্রযুক্তি, সেচ সুবিধা ও উচ্চ ফলনশীল জাতের উদ্ভাবনের মধ্যে দিয়ে ধানের জমির পরিমাণ কমলেও উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। এটি এ অঞ্চলের কৃষক, কৃষি দপ্তর ও উদ্ভাবকদের সফলতা। তবে উত্তরোত্তর যদি ধানের জমি কমে যায়, তবে অদূর ভবিষ্যতে নতুন সংকটের মুখে পড়তে হবে। অনেকে তিন ফসলি, দুই ফসলি জমিতে কারখানা, আবাসিক ভবন করছেন। যেটা আইনত নিষিদ্ধ। এছাড়া তিন ফসলি ধানের জমিতে পুকুর খননসহ ফলের বাগানেও নিষেধাজ্ঞা আছে। বিষয়টি সরকারের সুনজরে আছে। অচিরেই প্রশাসনিক তৎপরতাও হয়তো বাড়বে।