মঈন উদ্দীন, রাজশাহী: রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী প্রাচিনতম শতাধিক বছরের পূরনো রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগারটি নগরীর মিয়াপাড়ায়। ১৮৬৬ সালে পুরাতন বাসস্ট্যান্ডের কাশিমপুর হাউসে ছিল এই গ্রন্থাগারটি রাজা আনন্দনাথ প্রথম প্রতিষ্ঠা করেন। পরবির্তিতে ১৮৮৪ সালে রাজা দীঘাপতি রাজা প্রমথনাথ এই ভবন টি নির্মানের জন্য নগরীর মিয়াপাড়ায় ৪৪শতক জমি দান করেন। এখানেই তৈরি করা হয়েছিল দ্বিতল ভবন। এর খরচ বহন করেছিলেন কাসিমপুরের জমিদার কেদার প্রসন্ন লাহিড়ী। তাঁর বাবার নামে ভবনের মিলনায়তনের নাম রাখা হয়েছিল ‘গিরিশ চন্দ্র হল’। ১৮৮৪ সালের ৯ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগার। এই গ্রন্থাগারে ১০টি কক্ষ ছিল এবং সেই সময় লাইব্রেরীতে ১৮৭১-৭২ সালে ৩২৪৭ টি বই সংরক্ষন ছিলো। বর্তমানে বই রয়েছে ৩৬ হাজার। এর মধ্যে ২৯টি বইয়ে স্বহস্তে স্বাক্ষর করে পাঠিয়েছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ঐতিহ্যাবাহী এই গ্রন্থাগার দেখে অভিভূত হয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী, সরোজিনী নাইডু, মোহিতলাল মজুমদার, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, জলধর সেন, স্যার আজিজুল হক, সজনী কান্ত দাস, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, শরৎচন্দ্র বোসসহ আরও অনেকে। এ গ্রন্থাগার সম্পর্কে তাঁদের ভূয়সী প্রশংসা এখনো জ্বল জ্বল করছে গ্রন্থাগারটির মন্তব্য খাতায়। রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগারে যাতায়াত ছিল এমন বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, রমেশচন্দ্র মজুমদার (১৯২৯), জে জি ড্রমান্ড, রজনীকান্ত দাস, প্রফুল্ল কুমার সরকার, গডফ্রেজ যখমন, শিশির ভাদুড়ী প্রমুখ।
এই স্থাপনাটি কেবল গ্রন্থাগারই ছিল না, এ ভবনটিই রাজশাহীতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মূল সূতিকাগারও। কিন্তু পুনঃনির্মাণের কথা বলে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে ভবনটি ভেঙে ফেলে সিটি কর্পোরেশন।
বইগুলো রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন ভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। নগরীর সচেতন সমাজ বলেছিলেন, রাসিকের দায়িত্ব ছিল ঐতিহাসিক এই স্থাপনাকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে নতুন ভবন নির্মান করা। ঐতিহ্যবাহী এই ভবনটি ভাঙার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে রাজশাহীতে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। অবশ্য তাতে কোনো কাজ হয়নি। তাদের দাবি ছিল শতাব্দী প্রাচীন এই গ্রন্থাগারের সঙ্গে রাজশাহীর ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি জড়িয়ে রয়েছে। এটি ভেঙে ফেলা হলে সেই ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির অনেক স্মৃতিই মুছে যাবে। তবে সিটি করপোরেশন তাদের সিদ্ধান্তেই ছিল অটল। ভারত সরকারের ২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা অনুদানে গ্রন্থাগারটির নতুন পাঁচতলা ভবন নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে। এর মধ্যে শেষ হয়েছে কেবল পাইলিংয়ের কাজ। এতে খরচ হয়ে গেছে তিন কোটি ২৭ লাখ টাকা। এ অবস্থায় বন্ধ রয়েছে নির্মাণকাজ। এর সঙ্গে সিটি করপোরেশন আরও ৭০ লাখ টাকা ব্যয় করেছে। সিটি করপোরেশনের সুত্র বলছে, এখন নির্মাণকাজ শেষ করতে আরও প্রায় দুই কোটি টাকার প্রয়োজন। তারা নিজেরাই এই টাকার ব্যবস্থা করবে।
‘সামাজিক সাংস্কৃতিক পরিবেশ এবং প্রত্নতত্ত্ব অবকাঠামো উন্নয়নসাধন ও সংরক্ষণের মাধ্যমে রাজশাহী ও রাজশাহী মহানগরীর টেকসই উন্নয়ন প্রকল্পের অধীন-ঘোড়ামারা সাধারণ অডিটরিয়াম নির্মাণকাজ।’ এ প্রকল্পের অধীনে পুরোনো গ্রন্থাগারের জায়গায় ৫২ ফুট উঁচু পাঁচতলা ভবনের সমান স্থাপনা নির্মাণ করার কথা। যেখানে গ্রন্থাগারের পাশাপাশি ৩০০ আসনের একটি উন্নত মানের মিলনায়তন নির্মাণের কথা রয়েছে। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের বাস্তবায়নাধীন এ প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০১৯ সালের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নাম আরসিসি এল-আরইএমসি জেভি। ঠিকাদারের সঙ্গে এ নির্মাণকাজের চুক্তিমূল্য ছিল ২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা।
রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগারের নির্মাণকাজের অগ্রগতি সম্পর্কে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের প্রকৌশল দপ্তর জানায়, তাঁদের ধারণা ছিল, শুধু কলামের ওপরেই ভবন নির্মাণ করা যাবে। এই প্রাক্কলনের ওপর নির্ভর করেই ভারত সরকারের বরাদ্দ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই জায়গার মাটি খুব খারাপ। ৭০ ফুট পর্যন্ত ১১৩টি পাইলিং করতে হয়েছে, যা প্রাক্কলনের পুরোপুরি বাইরে ছিল। এতেই ভারত সরকারের অনুদানের ২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। তার সঙ্গে সিটি করপোরেশনের আরও ৭০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে। দপ্তরের সুত্রটি আরো জানায়, তাদের সঙ্গে চুক্তি ছিল প্রকল্প শেষ করতে যদি বাড়তি টাকার প্রয়োজন হয়, তবে তা রাজশাহী সিটি করপোরেশন দেবে। সে অনুযায়ী সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে টাকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদের ব্যাপারে সুত্রটি বলে মেয়াদ বাড়িয়ে দেওয়ার বিধান আছে। সেটা কোনো সমস্যা নয়।
রাজশাহী সিটি করেপারেশনের সেই সময়ের মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল সেই সময় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘ভবনটি অনেক পুরনো। এটি সংস্কার করে কোনও লাভ নেই। তাই ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে সেখানে থাকা দুর্লভ বইগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সেগুলো ডিজিটাল মাধ্যমে রূপান্তর করা হবে। সেই সঙ্গে ভবনটির বর্তমান আদলের একটি রেপ্লিকা তৈরি করে মূল ফটক করা হবে।’
সেই সময় সাহিত্য প্রেমীরা বলেছিলেন,‘ভবনটি ভেঙে না ফেলে সংস্কার-সংরক্ষণ করে এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আশপাশের ফাঁকা জায়গায় নতুন ভবন তৈরি করা যেতে পারে। নতুন কমপ্লেক্সের অর্থায়ন করছে ভারত। তাদেরও ভেবে দেখা দরকার ছিল, এমন একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী ভবনকে এভাবে ভেঙে ফেলা যায় কিনা।’ এখন তাদের প্রশ্ন কবে প্রাণ ফিরবে রাজশাহীর প্রাচীনতম এই সাধারণ গ্রন্থাগারটির?