আমিনুল ইসলাম হিরো:
বেশ কয়েকটা দিন যাবৎ ভাবছিলাম আমি ও আমরা যারা কমবেশি লেখালেখি করি তাদের জন্যই প্রয়োজন লেখালেখির শর্ত ও শর্তহীনতা নিয়ে কিছু কথা বলবো। সকল পাঠকের উদ্দেশ্যে বলেনেই আমার ক্ষুদ্রতম জ্ঞান থেকে এই লেখা। লিখনিতে ভুল হইলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। শুরুতেই আপনার কাছে আমার একটা প্রশ্ন রাখতে চাই। লেখালেখি কী? এক কথায় বলতে গেলে লেখালেখি হচ্ছে মনের প্রকাশ। সময়ের কাছে প্রেমপত্র। এরপরের প্রশ্ন এই সময়টা কোন সময়? লেখকের যাপিত সময়। কথা এখানেই শেষ নয়। লেখালেখি হচ্ছে সত্যকে উন্মোচন করা। সত্য কী? সত্য হচ্ছে আগুন। আগুনে হাত দেয়া মানে হাত পুড়ে যাবে। লেখালেখির গূঢ় শর্ত হচ্ছে অবিরাম জ্বলন্ত আগুনে হাত দেয়া।
জেনে বুঝে একজন কেনই বা আগুনে হাত দিতে যাবে? লেখালেখিতে একজনকে চেতনে অবচেতনে এই ঝুঁকি ও যন্ত্রণা অবিরত নিতেই হবে। আমি এখানে একটা জিনিস শুরুতেই পরিষ্কার করে নিতে চাই। লেখালেখির শর্ত এবং লেখক হবার শর্তের মধ্যে কিঞ্চিৎ পার্থক্য আছে। লেখালেখির শর্ত ও শর্তহীনতা নিয়ে নানা পরিসরের অনেক কথা বলার আছে। তবে লেখক হবার শর্ত একটাই। অবিরাম পড়ে যাওয়া, অবিরাম লিখে যাওয়া।
লেখালেখি একটা নেশা। একটা কথা আমি মানতে রাজি নই — কেউ যদি বলেন লেখালেখি আমার শখ, আমি শখ করে লিখি। শখের হাজারটা জিনিস থাকলেও লেখালেখিতে শখ জিনিসটা খাটে না।
জীবনের অন্যসব দাবি কানায় কানায় মিটিয়ে কেউ শখ করে নাম ফাটাবার জন্যে লেখালেখির যশ অধিকার করতে চায়। তাতে নির্লজ্জতাই প্রকাশ পায়। এই প্রবণতা হাল আমলে আমাদের দেশে আমলা বা পদধারী লোকদের মাঝে নির্লজ্জ এক মহামারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। লেখালেখির জন্যে চাই জীবনের সমান রক্ত। এখানে কাজী নজরুল ইসলামের একটা উপলব্ধির কথা উল্লেখ করা যায়। ‘সুখের কবিতা তোমরা লিখিও তোমরা যারা মহাসুখে আছো।’
এখানে আমার প্রশ্ন, বোধসম্পন্ন মানুষ এত সুখবোধ কোথায় পাবে? কেবল নির্বোধের পক্ষেই সুখী হওয়া সম্ভব আর এক কাঠা দাঁত বের করে ফেইসবুকে নিজের নির্লজ্জ উল্লাস সোৎসাহে প্রকাশ করা যায়। জীবনানন্দ দাশ বোধের সঙ্কটে ছিলেন, নির্বোধ হবার অভিপ্রায় থেকে মুক্ত ছিলেন, এরকম নির্লজ্জতা থেকে মুক্ত থাকেন আত্মমর্যাদা সম্পন্ন একজন জাতকবি। আত্মমর্যাদাবোধ বিবর্জিত একজন ব্যক্তি মানুষ হিসেবেই অপূর্ণ। লেখালেখিতে একজনকে পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে নিতে হয়, পরিপক্ক মানুষ হওয়াটা লেখালেখিতে টিকে থাকার পূর্বশর্ত।
লেখালেখির ক্ষমতা হলো কলমে। সঙ্গে থাকা চাই কল্পনা শক্তি এবং কাগজ। অসৎ লোকের জন্যে অন্য অনেক কাজ থাকলেও, লেখালেখি তার জন্যে নিষিদ্ধ। লেখালেখির আজন্ম দাবি হচ্ছে সত্যকে উন্মোচন করা, আগেই বলেছি যার মানে আগুনে হাত দেয়া। অসৎ লোক আগুনে হাত দেবার আগে সেই আগুনটাকে ফন্দি করে জল করে নিবেন। মানে দাঁড়ালো তিনি লেখালেখির নামে গোঁজামিল দিবেন, সত্য প্রকাশ দূরে থাক, বরং অন্য যারা সত্য প্রকাশ করবেন তাদেরকে ক্ষমতার জোরে ল্যাং মেরে পেছনে ঠেলে দিবেন। তিনি নিজে চামচামির নাজির উজিরের আশ্রয় নিবেন, তেলামি শুরু করে দিবেন নিজের সুবিধা আদায়ের মাধ্যম হিসেবে।
এতে ভয় পাবার কিছু নাই। আখেরে এরকম অসৎ লোকজন বা পদধারী নির্লজ্জ প্রজাতির মানুষগুলো যতই ঢাকঢোল পিটিয়ে আসুন, পত্রিকাগোষ্ঠীর সঙ্গে সিন্ডিকেট করে চলুন, সাহিত্য সম্পাদকদের নানা উপঢৌকন আর লোভ দেখিয়ে বশে রাখুন, তাতে কিচ্ছু লাভ হবে না।
লেখালেখি যদি সময়ের দাবি না মেটায় ওই লেখা রাজায় লিখলেও প্রজা পড়বে না। একটি লেখা সময়ের দাবি মেটালেও অচেনা অচ্ছুৎ প্রজা লিখলেও রাজার দৃষ্টিগোচর হতে পারে। আর ’পাঠ প্রজাতন্ত্রে’ এক একজন পাঠক এক একজন রাজা। আজ হোক কাল হোক, এমনকি একজন জাতলেখকের মৃত্যুর পরও তার লেখালেখি পাঠক খুঁজে বের করবেই। তাড়াহুড়োর কিছু নাই, হতাশ হবারও কিছু নাই।
লেখালেখির একজন পাঠক, যিনি রাজা হতে পারেন, উজির হতে পারেন, নাজির হতে পারেন এমনকি ফুটপাতে বসা মুচিও হতে পারেন। পাঠক হিসেবে মনের কোণের মানুষটি বড় এরোখা সার্বভৌম এক অস্তিত্ব। তবে এখানে শর্ত হলো লেখালেখিতে পাঠকের কথা মাথায় রাখলে সর্বনাশ। তাহলে প্রশ্ন থাকে। আপনি লিখবেন কার জন্যে? কারো জন্যেই নয়। তাহলে লিখবেন কেন?
ওই যে আপনার ভেতরের কিছু কথা আছে, কিছু সত্য প্রকাশ করার আছে। আপনি যে সত্য জানেন, আপনার যে গল্প তা আপনাকেই প্রকাশ করতে হবে। আপনার গল্প অন্য কেউ প্রকাশ করে দিবে না। এখানেই সময়ের প্রশ্ন, যাপিত সময়ের গল্প। লেখালেখির একটা শর্ত হলো আপনি শেষ নিশ্বাস নেবার আগে জীবনের কোনো গল্প অবলা রেখে যাবেন না।
এই যে যুগ যুগ ধরে এতো এতো লেখালেখি আর হাজার হাজার বই। তারপর এই সময়ের, অনাগত সময়ের একজন লেখকের লেখার এমন কী বাকি আছে বা লেখার আছে? ওই যে যাপিত সময় ও যাপিত জীবনের গল্প। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সময়ের গল্প, সময়ের খতিয়ান তাঁর লেখায় দিয়ে গেছেন। তিনি তো আপনার সময় আপনার যাপিত জীবনের কিছু বলে যাননি। এই কাজটুকু আপনার। এটা আপনার লেখালেখির শর্ত। আর শর্তহীনতা হচ্ছে লাভের আশা না করা। লেখালেখিতে লাভের গুড় পিঁপড়ায় খায়।
লেখালেখি একটা রোগ। তবে এই রোগ যোগ্য এবং পরিপক্ক মানুষের হলে ভালো। এই রোগ যদি মেধাহীন, আত্মমর্যাদাহীন, প্রতিভাহীন মানুষের পেয়ে বসে তাহলে ভয়ের ব্যাপার। আমরা এরকম একটা ভয়ঙ্কর সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। সোনার মোহর পচা নর্দমায় বা জঙ্গলে থাকলেও ঠিক ঠিক মহিমা বজায় রেখে আলোর বিকিরণ নিয়ে দৃষ্টিগোচর হবে। প্রকৃত মেধাবী প্রতিভাবান লেখক বস্তিতে থাকলেও আলো একদিন ছড়াবেনই। এরকম একজন আমলা হলেও দোষ নাই, তিনি জীবনে যাই কিছু করেন ভেতরের তিনি একজন জাতলেখক, তিনি তার ভেতরের ‘সেইজন’কে ঠিক ঠিক বাহিরপানে নিয়ে আসবেনই। তবে নিয়ে আসার এই কাজটি করতে হবে নিজের ভেতরের বিরামহীন তাগিদ থেকে। আমাদের এই সময়ের কতিপয় ‘নির্লজ্জ আমলা-লেখক’ প্রজাতির মতো করে অবশ্যই নয়।
নিজের ভেতরে বিরাজমান এই রোগ একজন জাতলেখক নিজের অজান্তেই ধরে ফেলেন। আর এই রোগ থেকে রেহাই পাবার জন্যে প্রকাশের উদ্যম ও উদ্যোগে নিজেকে নিয়োজিত করেন। এই নিমগ্নতা জীবনব্যাপী। কেবল মরণেই লেখালেখির শর্ত শেষ হতে পারে। আপনি যখন প্রেমে পড়েন, প্রকৃতই প্রেমে পড়েন, আমি প্রেমের নামে কোনো ‘নষ্টামি’র কথা বলছি না, তখন আপনার মাঝে শরীর ও মনে যে প্রতিক্রিয়া হয়, এরকম একটা অবস্থা একজন লেখকের কাছ থেকে লেখালেখি দাবি করে। এই দাবি যারা মেটাতে পারেন তারা হয়ে ওঠেন কালিদাস, লালন, ঈশ্বরগুপ্ত, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, হাসন রাজা, সুকান্ত, শামসুর রাহমান আর আহমদ ছফা।
লেখালেখির প্রেমে অবশ্যই পড়তে হবে। তবে নিজের লেখার প্রেমে পড়া যাবে না। একটি লেখা হয়ে গেলে, লেখকের দায় ওখানেই শেষ। এরপর তার ভাবনার জগৎ চলে যাবে পরের লেখার তাগিদে। এই তাগিদ একজন লেখক রপ্ত করতে না পারলে তাঁকে বন্ধ্যাত্ব বা writer’s block-এ পেয়ে বসবে।
লেখালেখিতে সংক্ষিপ্ত কোনো পথ নাই। সংক্ষিপ্ত পথে অতি অল্প সময়ে অধ্যাপক হয়তো হওয়া যেতে পারে, কিংবা রাতারাতি সচিব হওয়া সম্ভব। কিন্তু লেখালেখির পথ বড় দীর্ঘ যা লেখালেখির শুরু থেকে শেষে গিয়ে ঠেকে। আর এই শেষটা লেখকের মৃত্যুর মধ্যেই নিমজ্জিত। স্বভাবসুলভ প্রকাশই লেখালেখির শর্ত। পাণ্ডিত্য বলে বাহাদুরির জায়গা লেখালেখি না। লেখালেখির দেমাক সত্য প্রকাশে, অন্য কোথাও নয়। একজন সৎ লেখকের অহংকার করার কিছু যদি থাকে তা লেখালেখিতে তার সততা, তবে লেখালেখি কোনো অহংকারের বিষয় নয়। অহংকার পতনের মূল, এই কথাটা লেখালেখির বেলাতেও প্রযোজ্য।
সব লেখালেখিই আদতে কবিতা বা গল্প। গল্পেও যেমন কবিতার দাবি থাকে বা ভাষার কাব্যিকতা বিবেচ্য, তেমনি এক একটা কবিতাও আদতে গল্পই। যে কবিতায় গল্প থাকে না, সেটা আখেরে আর কবিতা হিসেবেও টিকে থাকে না। এই একই শর্ত অন্য সব লেখালেখির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। নাটক, উপন্যাস এমনকি প্রবন্ধকেও কবিতা ও গল্পের দাবি মেটাতে হয়। লেখালেখিতে এই শর্তগুলো দৃশ্যত ও অদৃশ্যতা বিরাজমান।
লেখালেখিকে কেউ যদি বৈষয়িক লাভালাভের সিঁড়ি ভেবে বসেন, তাহলে তিনি ওই সিঁড়ি পেলেও পেতে পারেন, বিনিময়ে লেখালেখিই হারিয়ে বসতে পারেন। লেখালেখিতে আপনার মনের সবটা থাকা চাই। আপনার পোশাকি পরিচয়ের যতটা সম্ভব বা পুরোটা অনুপস্থিত থাকলেই ভালো। লেখালেখিতে শর্ত ও শর্তহীনতার দায় মিটিয়ে আপনার পায়ের তলার মাটিটুকু খুঁজে নিন, সেই মাটির যত্ন নিন।
লেখকঃ কলাম লেখক ও
স্টাফ রিপোর্টার,এশিয়ান বার্তা২৪.কম।